Water Purifier

ওয়াটার পিউরিফায়ার কেনার আগে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন!

ওয়াটার পিউরিফায়ার কেনার আগে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন!

বাংলাদেশে Water Purifier এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং প্রতিটি পরিবারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং প্রয়োজন। বাড়ির ট্যাপ, ডিপ টিউবওয়েল কিংবা সরবরাহকৃত পানিতে প্রায়ই ব্যাকটেরিয়া, আয়রন, কেমিক্যাল এবং TDS (Total Dissolved Solids) বেশি পাওয়া যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। 

বিশেষ করে ঢাকা সহ দেশের অনেক অঞ্চলে পানির মান দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। কোথাও আয়রন বেশি, কোথাও আবার TDS বা লবণাক্ততা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এসব অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পরিবারকে নিরাপদ রাখতে একটি ভালো ওয়াটার পিউরিফায়ার এখন প্রয়োজনীয় সুরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

তবে বাজারে নানা ধরনের প্রযুক্তি, ফিচার এবং ফিল্টার সিস্টেম থাকায় কোন পিউরিফায়ারটি আপনার পরিবারের জন্য উপযোগী হবে এ বিষয়ে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান। আপনি যাতে একটি সঠিক ওয়াটার পিউরিফায়ার বেছে নিতে পারেন, তাই পিউরিফায়ার কেনার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা ও যাচাই করা অবশ্যই জরুরি।

পিউরিফায়ার কেনার আগে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি।

১. আপনার এলাকার পানির TDS লেভেল

একটি ভালো মানের ওয়াটার পিউরিফায়ার কেনার আগে প্রথম কাজ হলো আপনার এলাকার পানির TDS(Level of dissolved salts) জানা। কারণ পানির TDS বেশি হলে সাধারণ পিউরিফায়ার দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা যায় না। উচ্চ TDS-এ লবণ, ধাতু, কেমিক্যালের পরিমাণ বেশি থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই TDS ২০০-৩৫০ এর বেশি হলে RO পিউরিফায়ার আবশ্যক, আর কম হলে UV বা UF দিয়েও চলে, তবে নিরাপত্তা স্বার্থে RO পিউরিফায়ার ব্যবহার করা হয়।

২. পানিতে আয়রন, আর্সেনিক, ব্যাকটেরিয়া বা লবণাক্ততা আছে কি না

বাংলাদেশের অনেক এলাকায় পানিতে আয়রন, আর্সেনিক, ব্যাকটেরিয়া এবং লবণাক্ততা বেশি পাওয়া যায়। এসব উপাদান শরীরের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। তাই পানির ধরন বুঝে ঠিক করতে হবে কোন ধরনের পিউরিফায়ার প্রয়োজন। ব্যাকটেরিয়া বেশি হলে UV, আর আর্সেনিক/লবণাক্ততা বেশি হলে RO-ই সেরা।

৩. কোন প্রযুক্তি প্রয়োজন: RO / UV / UF / RO+UV+UF

ওয়াটার পিউরিফায়ার বেছে নেওয়ার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচন করা। ভুল প্রযুক্তির পিউরিফায়ার কিনলে শুধু টাকাই নষ্ট হবে না, পানিও যথাযথভাবে বিশুদ্ধ হবে না। যা পরিবারে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই প্রথমেই বুঝতে হবে আপনার এলাকার পানির সমস্যা ঠিক কোন ধরনের।

যদি পানিতে TDS (Total Dissolved Solids) বেশি থাকে, অর্থাৎ লবণাক্ততা, আয়রন, আর্সেনিক, ফ্লোরাইড বা অন্যান্য ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকে, তাহলে RO (Reverse Osmosis) প্রযুক্তি ছাড়া কার্যকর সমাধান নেই। RO পানির অতিরিক্ত লবণ, ক্ষতিকর ধাতু ও রাসায়নিক প্রায় ৯০–৯৫% পর্যন্ত দূর করে পানি করে আরও নিরাপদ ও স্বাদযুক্ত।

আর যেখানে জীবাণুর সমস্যাই বেশি, তবে পানি তুলনামূলক স্বচ্ছ এবং TDS কম, সেখানে UV (Ultraviolet) পিউরিফায়ার খুব ভালো কাজ করে। UV প্রযুক্তি পানিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও মাইক্রোব নিষ্ক্রিয় করে দ্রুত পানিকে নিরাপদ করে।

যে-সব এলাকায় পানি দেখতে ঘোলা থাকে বা কাদামাটি ও দৃশ্যমান কণার পরিমাণ বেশি, তবে TDS কম। সেখানে UF (Ultrafiltration) ভালো অপশন। এটি বিদ্যুৎ ছাড়াই কণাজাত ময়লা ছেঁকে পানি পরিষ্কার রাখে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই এলাকায় কখনো TDS বেশি, আবার কখনো ব্যাকটেরিয়ার সমস্যা বাড়ে। এ ধরনের “মিশ্র” সমস্যায় সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হলো RO + UV + UF কম্বো পিউরিফায়ার। এটি রাসায়নিক, লবণ, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ময়লা সবকিছু ফিল্টার করে সম্পূর্ণ নিরাপদ পানি নিশ্চিত করে।

অতএব, আপনার পানির মান কেমন তা আগে পরীক্ষা বা অন্তত স্থানীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বুঝে নিয়ে, সেই অনুযায়ী প্রযুক্তি বেছে নেওয়াই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত।

৪. পিউরিফায়ারের ফিল্টার স্টেজ কতটি?

৫. মেমব্রেনের গুণমান (বিশেষ করে RO-এর ক্ষেত্রে)

RO Water Purifier এর মূল অংশ হলো RO মেমব্রেন। মেমব্রেন ভালো না হলে পানি ঠিকমতো পরিশোধিত হবে না এবং ফিল্টার দ্রুত নষ্ট হবে। তাই ব্র্যান্ডেড, উচ্চ-মানের RO মেমব্রেন যুক্ত পিউরিফায়ার নেওয়া সবসময় উত্তম। এটি দীর্ঘমেয়াদে ভালো পানি দেয় এবং মেইনটেন্যান্স খরচও কম হয়।

৬. ফিল্টার পরিবর্তন খরচ ও Annual Maintenance Cost (AMC)

পিউরিফায়ার একবার কিনলেই খরচ শেষ নয়। ফিল্টার নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিবর্তন করতে হয়। তাই আগে থেকে জেনে নিন কোন মডেলের ফিল্টার কতদিন টেকে এবং এর পরিবর্তন খরচ কত। Annual Maintenance Cost জেনে রাখলে ভবিষ্যতের বাজেট প্ল্যান করতে সুবিধা হবে।

ফিল্টারের নামপরিবর্তনের সময়কেন পরিবর্তন করতে হয়আনুমানিক খরচ (BDT)
PP (Sediment) Filter1–3 মাসমাটি, বালু, ধুলো আটকায়100–150৳
Carbon Filter (Activated Carbon / CTO / GAC)3–6 মাসগন্ধ, ক্লোরিন, কেমিক্যাল দূর করে300–800৳
UF Filter12 মাসব্যাকটেরিয়া ও মাইক্রো-পার্টিকল ফিল্টার করে800–1,500৳
RO Membrane1.5–2 বছরউচ্চ TDS ও ভারী ধাতু অপসারণ করে1,000–2,500৳
UV Lamp1 বছরজীবাণুনাশক আলো কমে যায়500–1,500৳
Alkaline Filter1 বছরpH ব্যালেন্স করে ও মিনারেল রিস্টোর করে800–1,500৳
Mineral / TDS Controller Filter1 বছরপ্রায়শই মিনারেল অ্যাডজাস্ট করে700–1,500৳
Post Carbon Filter (Taste Enhancer)1 বছরপানি স্বাদ উন্নত করে800–1,500৳

৭. দৈনিক পানি ব্যবহারের হিসাব অনুযায়ী ক্যাপাসিটি

আপনার পরিবারে দিনে কত লিটার পানির প্রয়োজন, তার ওপর নির্ভর করে পিউরিফায়ারের ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করতে হয়। ৩-৪ জনের পরিবারের জন্য ৭–৮ লিটার, আর বড় পরিবারের জন্য ১০–১২ লিটার ট্যাংক ভালো। কম ক্যাপাসিটির ট্যাংকে বারবার রিফিলের ঝামেলা হয়।

৮. ব্র্যান্ডের ওয়ারেন্টি ও আফটার-সেলস সার্ভিস

ওয়াটার পিউরিফায়ার একটি দীর্ঘমেয়াদি ইলেকট্রনিক পণ্য, তাই ভালো ব্র্যান্ড বেছে না নিলে সার্ভিস সমস্যা হতে পারে। ওয়ারেন্টির মেয়াদ, সার্ভিস সাপোর্ট, স্পেয়ার পার্টস পাওয়ার সুবিধা। সবকিছু দেখেই ব্র্যান্ড নির্বাচন করতে হবে। ভালো সার্ভিস পাওয়া গেলে পণ্যের আয়ু অনেক বেড়ে যায়। 

ক্লিনটেক ইঞ্জিনিয়ারিং এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বস্ততার সাথে ওয়াটার পিউরিফায়ার ইন্ডাস্ট্রিতে পণ্য সরবরাহ এবং সার্ভিস দিয়ে আসছে। তাই আপনি নিশ্চিন্তে আপনার পরিবারের জন্য একটি ভালো মানের ওয়াটার পিউরিফায়ার সরবরাহ করতে পারেন।

৯. পানি সংরক্ষণের ট্যাঙ্কঃ স্টেইনলেস স্টিল নাকি ফুড-গ্রেড প্লাস্টিক?

যে ট্যাংকে পানি জমা থাকে তার উপাদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্টেইনলেস স্টিল ট্যাংক বেশি নিরাপদ ও টেকসই, আর ফুড-গ্রেড প্লাস্টিক ট্যাংকও ভালো মানের হলে সমস্যাহীন। তবে নিম্নমানের প্লাস্টিক ট্যাংকে পানি বসে থাকলে গন্ধ হতে পারে, তাই উচ্চমানের ট্যাংক বেছে নেওয়া জরুরি।

১০. পানি ফিল্টার করার গতি (L/hr)

বেশি মানুষের বাসায় বা অফিসে দ্রুত পানি প্রয়োজন হলে ফ্লো রেট বেশি (যেমন ১২–১৫ লিটার/ঘণ্টা) এমন পিউরিফায়ার নেওয়া ভালো। ফ্লো রেট কম হলে পানি ফিল্টার হতে সময় বেশি লাগবে এবং ব্যবহারে বিরক্তি বাড়বে।

১১. পিউরিফায়ার স্থাপনের জায়গা ওয়াল-মাউন্টেড / আন্ডার-সিঙ্ক

আপনার রান্নাঘরে কোথায় জায়গা আছে তার ওপর নির্ভর করে পিউরিফায়ার নির্বাচন করতে হবে। ওয়াল-মাউন্টেড মডেলগুলো বেশি কমপ্যাক্ট এবং চোখে পড়ে। আবার আন্ডার-সিঙ্ক (Undersink Water Purifier) মডেলগুলো পুরোপুরি লুকানো থাকে, যা কিচেনকে আরও পরিপাটি দেখায়।

১২. বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং পণ্যের স্থায়িত্ব

পিউরিফায়ার নিয়মিত চালু থাকে, তাই বিদ্যুৎ খরচ কম হলে দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয় হয়। পাশাপাশি মোটর, ফিল্টার বডি ও ইলেকট্রনিক অংশগুলো কতটা টেকসই তা ব্র্যান্ড ও রিভিউ দেখে যাচাই করা উচিত।

১৩. অতিরিক্ত ফিচার: TDS Controller, Mineral Booster, Auto Flush, Filter Alert

এখনকার আধুনিক পিউরিফায়ারগুলোতে অনেক সুবিধা থাকে যা ব্যবহারকে আরও সহজ করে। TDS Controller পানি স্বাদের ভারসাম্য রাখে, Mineral Booster প্রয়োজনীয় মিনারেল যুক্ত করে, Auto Flush মেমব্রেন পরিষ্কার রাখে, আর Filter Alert পরিবর্তনের সময় জানিয়ে দেয়। এসব ফিচার থাকলে অভিজ্ঞতা আরও উন্নত হয়।

১৪. ব্র্যান্ড রিভিউ ও সার্ভিস সেন্টারের অবস্থান

কোন পণ্য কিনবেন তার আগে সবসময় গুগল রিভিউ, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব ফিডব্যাক দেখে নিন। বিশেষ করে আপনার এলাকার কাছে সার্ভিস সেন্টার আছে কি না এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ কোনো সমস্যা হলেই দ্রুত সাহায্য পাওয়া যায়।

১৫. বাজেট ও বাজারদরের তুলনা

আপনার বাজেট অনুযায়ী বাজারে কোন ব্র্যান্ড কী সুবিধা দিচ্ছে তা তুলনা করা গুরুত্বপূর্ণ। একই দামের মধ্যে কিছু ব্র্যান্ড বেশি স্টেজ, ভালো মেমব্রেন বা উন্নত সার্ভিস দিয়ে থাকে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হিসেব করে নিলে সেরা ভ্যালু পাওয়া যায়।

উপসংহার

বিশুদ্ধ পানি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদা, আর সেই নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা দিতে একটি ভালো ওয়াটার পিউরিফায়ার এখন আর বিলাসিতা নয় বরং পরিবারের জন্য অপরিহার্য একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা। তবে বাজারে অসংখ্য প্রযুক্তি, মডেল ও ব্র্যান্ড থাকায় সঠিক পিউরিফায়ার বেছে নেওয়া সবসময় সহজ হয় না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার এলাকার পানির মান, TDS লেবেল, জীবাণু সমস্যা, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, ফিল্টার পরিবর্তন খরচ, স্টোরেজ ক্যাপাসিটি ও বাজেট এসব বিষয় ভালোভাবে বুঝে নেওয়া জরুরি।

সঠিকভাবে নির্বাচিত পিউরিফায়ার শুধু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহই করে না বরং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমায়, চিকিৎসা ব্যয় বাঁচায় এবং পরিবারের সবার সুস্থতা নিশ্চিত করে। তাই তাড়াহুড়ো নয় নিজের পানির সমস্যাটি বিবেচনা করে উপযুক্ত RO, UV, UF বা কম্বো প্রযুক্তির পিউরিফায়ার বেছে নিন। মনে রাখবেন, বিশুদ্ধ পানি বিনিয়োগ নয় এটি আপনার পরিবারের সুস্থ ভবিষ্যতের একটি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত।

author-avatar

About Md. Monirul Islam

I’m Md. Monirul Islam, Founder & Director of CleanTech Engineering Ltd. My journey in environmental engineering started with a passion for solving Bangladesh’s water challenges. Over the years, I’ve worked with organizations like the Department of Environment (DOE), PGCB, Enviro Consultants Ltd., BEEA, and Techno Bangla Engineering Ltd., gaining hands-on expertise in water purification, ETP design, and sustainable sanitation systems.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *